লাল মিয়া নামেই ডাকতো
রোদ্দুরে গেলে গায়ের রং লাল হয়ে যেত। তাইতো ছেলেবেলায় সবাই লাল মিয়া নামেই ডাকতো। সেই থেকে তারাও লাল কাকু বলেই চিনতেন। কুড়িগ্রাম আর মাছিমদিয়া পাশাপাশি গ্রাম। ছোটবেলায় দেখেছেন লালকাকু তাদের বাড়িতে আসতেন। বিয়ে হলে পর জানতে পান তার স্বামী হরিপদ সাহার সাথেও সুলতানের বেশ সখ্যতাছিল। এমন কথাই বলেছিলেন ২০১৭ সালে ২৬ জুন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএমসুলতানের কন্যাখ্যাত নিহারবালা সাহা। কথোপকথনে জানতে চেয়েছিলেম, সুলতান কেন নারীরূপ ধারণ করতেন, সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করতেন আর বিয়ে না করার নেপথ্যে কোন ঘটনা রয়েছে কিনা এমন কিছু বিষয়ে। কমতো নয়; বাল্যকালেতো দেখেছেন বটে তারপর ৩৫টি বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে সুলতানের মৃত্যু অবধি শিল্পীকে দেখভাল করেছেন। প্রায় ৩ যুগের স্মৃতি নিয়ে আমার সাথে কথা বলার সময় ৯৩ বছরের নিহারবালাও বলেছিলেন-তিনি এখন সুলতান কাকুর অপেক্ষায়।
কলকাতা আর্ট কলেজের পাঠ শেষ না হতেই সুলতানের বিবাগীমন বেড়িয়েপড়েন, ছবি আঁকেন এদেশ থেকে ওদেশ ঘুড়ে। এরপর ১৯৫৩ সালে নিজ গায়ে ফিরেন। ওসময় নড়াইল শহরের মুচির পোলে, গোডাউনে শ্রমিকদের সাথে বেশ করে মিশতেন। কোমড় অবধি চুল আর বসন দেখে পাগল বলে ইটপাটকেলের আঘাত সইতে হয়েছে। নড়াইল জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত সর্বমঙ্গলা কালি মন্দিরের বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতেন অনেকটা সময়। নিহার বালা বলেন, একদিন মন্দিরের পুরোহিত টুগলা ঠাকুরকে মা কালি স্বপ্ন দেখান ‘লাল এসে তাঁর মন্দিরে যেন বাঁশি বাজায়’। তাই করেছিলেন এসএম সুলতান। তাঁর চিড়িয়াখানায় পাঁচ হাত লম্বা বিষধর সাপ ছিল। একদিন নিহার বালা রান্না করতে গিয়ে দেখেন বিষধর সাপ ফণা তুলে আছে। কাকু এসে চলে যেতে বলতেই সাপটি ফণা গুটিয়ে চলে গেল। তাঁর সম্মোহনি শক্তি ছিল বেশ। কোন কোন দিন ঘরে কিচ্ছু নেই রান্না হবে কি করে, সাথে চিড়িয়াখানার প্রাণিদের খাবার যোগান হবে ক্যামনে? এমন সময় কাকু চিন্তা করতে মানা করতেন। সত্যিই কিভাবে যেন টাকার জোগান হয়ে যেত!
কাকু শিশুদের পাশাপাশি গাছপালা, জীবজন্তু খুউব পছন্দ করতেন। নাটক করতেন, কুচি দিয়ে শাড়ি পড়তেন। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বাঁশি নিয়ে বের হয়ে যেতেন। যার অর্থ এক খেয়ালী মানুষ বইতো তাঁর মনে। নারীদের বেশ সম্মান করতেন। বলতেন-‘মায়ের জাত নীচু করতে নেই’। দেখেন আমার মেয়ে পদ্ম এখন অসুস্থ। সুলতান কাকু বেঁচে থাকলে কোথায় কোথায় চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতেন।
এমন কথার ফাঁকেই জানতে চাইলুম, এসএম সুলতান বিয়ে করেননি কেন? নিহার বালার জবাব ছিল-বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কাকু বলেছিলেন, আমি বিয়ে করেছি জানেন না। এই বলে ছবি দেখায়ে দিতেন। তখন নিহার বালা পাল্টা উত্তর করতেন-এতো ভাত রেধে দিতে পারেনা।
সুলতানের সান্ত্বনার জবাব-‘বিয়ে করলে সংসারে ছবি আঁকা যায় না’। সম্ভবত কাকুর দেখানো পথ ধরেই তাঁর সাথে ছবি আঁকতে গিয়ে আমার ছোট ভাই দুলাল সাহাও অকৃতদার হয়ে ২০১৪ সালে মারা যায়। তাছাড়া কাকুর বাল্যকালে অভাবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁর এক সৎভাই ছিলেন বটে; তবে বোহেমিয়ান জীবনের সমাপ্তি টেনে সংসারী করাতে পারেনি। অক্ষেপ নিয়ে বললেন, নামেই কেবল সুলতান; পিছনে ফকির করে রাখা হয়েছে কাকুকে। যেমন ডিগ্রী না থাকায় ১৯৫৩ সালে ঢাকা থেকে অবহেলিত হয়ে শিক্ষিত সমাজ থেকে নিম্ন স্তরে চলে আসেন। যশোরের পালপাড়া বস্তি, এমএম কলেজের পুরানো হোস্টেলে থেকেছেন। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলার পর ১৯৮৩ সালে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে সাভারে পুকুরসমেত ৩ তলার বাড়ি। ঠিক ৪ দিন পর ট্রাক ডেকে মালামাল ভর্তি করে সবাইকে নিয়ে ফের নড়াইলে চলে আসা। তাঁর উক্তি ছিল-‘ইট পাথরের মধ্যে থাকবো না’। নিহার বালা প্রশ্ন তুলেছিলেন,তাহলে জল খেতে ভাঙ্গা দালানেই যাবেন? এসএম সুলতানের জবাব-‘ভাঙ্গা দালানেই কত শান্তি’।
শেখ মহম্মদ সুলতানের ছবি নিয়ে নিহার বালা বলেন, বিমূর্ত ধারার ছবি কথা বলে না। কাকু বাস্তব ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। কৃষিনির্ভর দেশ বলে বলতেন-‘কৃষকের ফলানো ফসল খেয়ে আমরা মোটাহচ্ছি। কৃষকদের কেন দুর্বল করে দেখাবো’। তিনি কৃষক, জেলে, জেলেবউ এদের ছবি আঁকতেন। আর বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই ছবি আঁকতে হবে এই চিন্তা থেকেই শিশুদের জন্য ‘শিশু স্বর্গ’ নামক নৌকা তৈরী। এই নৌকায় শিশুদের নিয়ে কাকু সকাল থেকে বেড়িয়ে গাজীর হাট থেকে খুলনা হয়ে ফের সন্ধ্যা নাগাদ ফিরতেন। প্রকৃতি দেখে ছবি আঁকা শিখানো হতো শিশুদের। এমন মানুষ এসএম সুলতান ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মৃত্যুর আগে কাকু বলেছিলেন-হিন্দু মানুষের কাছে থাকি কেউ সমাধিতে আসবেনা। তবে আপনি, দুলাল, বাসনা আর পদ্মমিলে আমার মৃতদেহ গাছের নীচে মাটিচাপা দিয়ে রাখবেন। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সমাধির পাশে সুলতান কাকুকে সমাহিত করা হবে। কিন্তু নিহার বালা এসএম সুলতানের মৃতদেহ নিয়ে আসেন কুড়িগ্রামে। লোক ডেকে এনে জানাযা পড়ায়ে সমাহিত করেন।
ফের স্মৃতিচারণ, রক্ত আমাশয় হলে মুচির পোলে পড়েছিলেন সুলতান কাকু। আমি কিছুটা নাসিংয়ের কাজ জানতাম। মোল্লা সাইদুর মিয়া আমায় বলেছিলেন, নিহার তুমি গিয়ে একটু দেখো। ওই থেকে মৃত্যু অবধি কাকু আমাদের পরিবারের সাথে। কোথায়ও কোন খাবার দিলে পকেট পুরে আমার মেয়েদের জন্য নিয়ে আসতেন। এমন কত স্মৃতিকথা। এ সময় নিহার বালার শীর্ণ শরীর আর নব্বই পেড়ুনো বয়সের ভাড়ে ফিকে হয়ে আসা ধূসর চোখে অপলক দৃষ্টি। গলা ধরে আসায় কিছুটা ভাড়ি স্বরে বলেন, কাকু দেবতুল্য মানুষ। কখনো অসম্মান করে কথা বলেননি। রাগ করেননি কোনদিনও। অমন মানুষের দেখা মেলাভাড়। কথোপকথনের ঠিক পাঁচবছর পর এই লেখা। জেনেছি ৯৮ বছর বয়স নিয়ে অসুস্থ হয়ে বেঁচে আছেন নিহার বালা।
Leave a Reply